আল্লাহর ইচ্ছায় প্রকৃতির অমোঘ নিয়মেই ঋতুর পালাবদল ঘটে। প্রকৃতির আচরণ মানুষের অসহায়ত্বকে আরও প্রকট করে তোলে। হিমেল হাওয়া ও তীব্র শৈত্যপ্রবাহ দরিদ্র জনগোষ্ঠী-অধ্যুষিত অঞ্চলে বিরূপ প্রভাব ফেলে। প্রচণ্ড শীতের প্রকোপ থেকে আত্মরক্ষার জন্য হতদরিদ্র অনেক মানুষেরই নেই ন্যূনতম শীতবস্ত্র, খাদ্যদ্রব্য, ওষুধপথ্য, উপযুক্ত আশ্রয় বা বাসস্থান। হাড়কাঁপানো শীতে তাদের কাউকে খোলা আকাশের নিচে রাত যাপন করতে হয়। ছিন্নমূল অসহায় মানুষকে খড়কুটা জ্বালিয়ে শীত মোকাবিলার প্রয়াস চালাতে দেখা যায়। তাই সবার প্রতি দয়া প্রদর্শন করতে বলা হয়েছে। যার অন্তরে দয়ামায়া আছে, যে পরোপকারী, আল্লাহ তাকে ভালোবাসেন। এ জন্য রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘তোমরা ক্ষুধার্তকে খাদ্য দাও, রুগ্ণ ব্যক্তির সেবা করো এবং বন্দীকে মুক্ত করো অথবা ঋণের দায়ে আবদ্ধ ব্যক্তিকে ঋণমুক্ত করো।’ (বুখারি)
শীতার্ত মানুষের প্রতি সমাজের সামর্থ্যবান ও বিত্তশালীদের সাহায্য ও সহানুভূতির হাত সম্প্রসারিত করা প্রয়োজন। পর্যাপ্ত পরিমাণে শীতবস্ত্র সরবরাহ করে সাধ্যমতো শীতার্তদের পাশে এসে দাঁড়ানো দরকার। নিঃস্বার্থভাবে বিপদগ্রস্ত মানুষের সাহায্য ও সেবা করাই মানবধর্ম। এ মহৎ ও পুণ্যময় কাজই সর্বোত্তম ইবাদত। অসহায় মানুষের দুর্দিনে সাহায্য, সহানুভূতি ও সহমর্মিতার মনমানসিকতা যাদের নেই, তাদের ইবাদত-বন্দেগি আল্লাহর দরবারে কবুল হয় না। সুতরাং নামাজ, রোজার সঙ্গে কল্যাণের তথা মানবিকতা ও নৈতিকতার গুণাবলি অর্জন করাও জরুরি। এ সম্পর্কে পবিত্র কোরআনে ইরশাদ হয়েছে, ‘পূর্ব ও পশ্চিম দিকে তোমাদের মুখ ফেরানোতে কোনো পুণ্য নেই, কিন্তু পুণ্য আছে কেউ আল্লাহ, পরকাল, ফেরেশতাগণ, সব কিতাব এবং নবীদের প্রতি ইমান আনয়ন করলে এবং আল্লাহ-প্রেমে আত্মীয়স্বজন, এতিম, মিসকিন, পর্যটক, সাহায্যপ্রার্থীদের এবং দাসমুক্তির জন্য অর্থ দান করলে, নামাজ প্রতিষ্ঠা করলে ও জাকাত প্রদান করলে এবং প্রতিশ্রুতি দিয়ে তা পূর্ণ করলে, অর্থসংকটে, দুঃখ-ক্লেশে ও সংগ্রাম-সংকটে ধৈর্য ধারণ করলে। এরাই তারা, যারা সত্যপরায়ণ এবং তারাই মুত্তাকি।’ (সূরা আল-বাকারা, আয়াত: ১৭৭)
তীব্র শীতের প্রকোপে নিদারুণ কষ্ট ও দুঃসহ অবস্থায় পড়ে মানবেতর জীবন যাপন করছে দেশের লাখ লাখ দুস্থ, নিঃস্ব, ছিন্নমূল, গরিব, দুঃখী, বস্ত্রহীন শিশু, বৃদ্ধ, নারী-পুরুষ। শীতজনিত রোগের প্রাদুর্ভাব থেকে রক্ষা পেতে প্রয়োজন সুচিকিৎসা, ওষুধপথ্য এবং শীত মোকাবিলায় সরকারি বা বেসরকারিভাবে কার্যকর উদ্যোগ। বিশেষ করে শিশুরা গণহারে গুরুতর শীতজনিত রোগে আক্রান্ত হওয়ায় তাদের চিকিৎসার ব্যাপারে পর্যাপ্ত ব্যবস্থা না নিলে শীতের দুর্ভোগে মৃত্যুর হারও বাড়বে। এ জন্য জাতি-ধর্ম-বর্ণ দলমত-নির্বিশেষে বিত্তবানদের শীতার্ত বস্ত্রহীন মানুষের পাশে অবশ্যই দাঁড়ানো উচিত। নবী করিম (সা.) পরকালীন পুরস্কারপ্রাপ্তির কথা ঘোষণা করেছেন, ‘এক মুসলমান অন্য মুসলমানকে কাপড় দান করলে আল্লাহ তাকে জান্নাতের পোশাক দান করবেন। ক্ষুধার্ত অবস্থায় খাদ্য দান করলে আল্লাহ তাকে জান্নাতের সুস্বাদু ফল দান করবেন। কোনো মুসলমানকে তৃষ্ণার্ত অবস্থায় পানি পান করালে আল্লাহ তাকে জান্নাতের সিলমোহরকৃত পাত্র থেকে পবিত্র পানি পান করাবেন।’ (আবু দাউদ)
তীব্র শীত নিবারণে দুর্গত অঞ্চলে শীতবস্ত্র বা গরম কাপড়, ওষুধপথ্য সরবরাহ অত্যন্ত জরুরি হয়ে পড়েছে। দুর্যোগময় মুহূর্তে মন-প্রাণ খুলে আর্তমানবতার সেবায় সাহায্যের হাত বাড়ানো; খাদ্য, ওষুধ, পথ্য, শীতবস্ত্র এবং জরুরি ত্রাণসামগ্রী নিয়ে বিপদগ্রস্ত মানুষের পাশে যাওয়া এবং দুস্থ মানবতার সেবার মতো শ্রেষ্ঠ কর্মে অগ্রসর হওয়া অবশ্যকরণীয়। শৈত্যপ্রবাহসহ বিভিন্ন প্রাকৃতিক বিপর্যয়ে আল্লাহ তাআলা ধর্মপ্রাণ মানুষের ইমানের দৃঢ়তা পরীক্ষা করেন, আর দেখেন বিপদগ্রস্ত অসহায় মানুষের জন্য কারা সাহায্য-সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দেয়।
যারা শীতজনিত রোগব্যাধিতে অবর্ণনীয় দুঃখ-কষ্টে ভুগছে, তাদের জন্য জরুরি ভিত্তিতে ওষুধপথ্য ও সুচিকিৎসার বন্দোবস্ত করা একান্ত প্রয়োজন।
যাদের মাথা গোঁজার ঠাঁই নেই, তাদের দুরবস্থা যে সর্বাধিক, সে কথা বলাই বাহুল্য। হাড়কাঁপানো শীতে যে বিপুল জনগোষ্ঠী বর্ণনাতীত দুঃখ-কষ্টে দিন যাপন করছে তাদের পাশে দাঁড়ানো ধর্মপ্রাণ মানুষের নৈতিক দায়িত্ব। রাসুলে করিম (সা.) বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি কোনো মুমিনের পার্থিব একটি মুসিবত দূর করবে, আল্লাহ কিয়ামতের দিন তার মুসিবতসমূহ দূর করে দেবেন। আর যে ব্যক্তি কোনো অভাবী মানুষকে সচ্ছল করে দিবে, আল্লাহ তাকে ইহকাল ও পরকালে সচ্ছল করে দিবেন এবং আল্লাহ বান্দার সাহায্য করবেন যদি বান্দা তার ভাইয়ের সাহায্য করে।’ (মুসলিম)
সমাজের বিত্তবান ব্যক্তি, ব্যবসায়ীসহ সামাজিক স্বেচ্ছাসেবামূলক সংস্থা ইচ্ছা করলে তাদের নিজ নিজ এলাকার শীতার্ত অসহায় গরিব-দুঃখী মানুষের মধ্যে বিতরণের জন্য শীতবস্ত্র সংগ্রহ এবং প্রেরণ করতে পারেন। হাদিস শরিফে উল্লেখ আছে, ‘যে ব্যক্তি আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য দুনিয়াতে মানুষকে খাদ্য দান করেছে, সেদিন (রোজ কিয়ামতের দিন) তাকে খাদ্য দান করা হবে। যে আল্লাহকে খুশি করার জন্য মানুষকে পানি পান করিয়েছে, তাকে সেদিন পানি পান করিয়ে তার পিপাসা দূর করা হবে। যে মানুষকে বস্ত্র দান করেছে, তাকে সেদিন বস্ত্র পরিধান করিয়ে তার লজ্জা নিবারণ করা হবে।’
প্রত্যেক ধর্মপ্রাণ মানুষেরই পারস্পরিক মানবতাবোধ ও উদারনৈতিক মনমানসিকতা থাকা অপরিহার্য। একজন মানুষ বিপদে পড়লে বা ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে অসহায় হলে তাকে যথাসাধ্য সাহায্য করা সমাজের বিত্তবান প্রতিবেশীদের ইমানি দায়িত্ব ও মানবিক কর্তব্য। সব মানুষের উচিত সমগ্র সৃষ্টির প্রতি দয়ামায়া, অকৃত্রিম ভালোবাসা, সৌহার্দ্য, সম্প্রীতি ও সহানুভূতি বজায় রাখা। তাই দেশের সর্বস্তরের ধনাঢ্য, বিত্তবান, শিল্পপতি ব্যবসায়ীদের প্রতি উদাত্ত আহ্বান জানাচ্ছি, এ শীতের মৌসুমে গরিব, অসহায়, দুঃখী মানুষকে সামর্থ্য অনুযায়ী শীতবস্ত্র দিয়ে সাহায্য করুন!
ড. মুহাম্মদ আবদুল মুনিম খান: বিশ্ববিদ্যালয়ের সহযোগী অধ্যাপক, গবেষক ও কলাম লেখক।
No comments:
Post a Comment
Zajakallah Khairan